Monday, January 14, 2019

"ভাদু"

-:: ভাদু ::-

আপনি কি কখনও ভাদ্র মাসে বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া বা পশ্চিম বর্ধমানে বেড়াতে গেছেন? যদি না গিয়ে থাকেন, অথচ বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকগানকে ভালোবাসেন তাহলে কিন্তু লেখাটা সম্পূর্ণ পড়ার পর না গিয়ে থাকতে পারবেন না। তাই প্রথমেই বলে রাখছি আগে বাংলা ক্যালেন্ডার দেখে ভাদ্র মাসের শেষের দিকে কয়েকটা ছুটির দিন ঠিক করে বেছে নিন, তারপর না হয় লেখাটা পড়তে বসুন।
                    কি, দেখলেন? যদি বেশ কিছুদিনের ছুটির ব্যবস্থা করে ফেলতে পারেন তাহলে বিহারের ধানবাদ, জামতারা বা ঝারখণ্ডের সিংভূম থেকেও ঘুরে আসতে পারেন কিন্তু। আসলে এই সকল জায়গাতেই "ভাদু উৎসব" বা "ভাদু পূজা" অনুষ্ঠিত হয়। "ভাদু" নামের সাথে "পূজা" শব্দটি জড়িত আছে বলে যেন আবার এটিকে ধর্মানুষ্ঠান মনে করে বসবেন না। আসলে ভাদু হিন্দুর "তেত্রিশ কোটি" দেব দেবীর কোন বংশধরও না, এমনকি বিভিন্ন লৌকিক দেবীদের পূজা পদ্ধতির সঙ্গেও ভাদু পূজার কোনো মিল নেই। এখানে পূজা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কেবলই শ্রদ্ধার্থে। এই পূজায় ধূপ নেই, চন্দন নেই, পুষ্পাঞ্জলী নেই, অর্ঘ্য নেই, মন্ত্র নেই, পুরহিতও নেই, আছে শুধু সংগীত আর সংগীত। গানই হল ভাদু উৎসবের প্রধান এবং একমাত্র অঙ্গ।

বেড়ো যাব পদ্ম আনব,
তার বেনাব সিংহাস্ন।
তার ভিতরে খেলা করে
রাজকুমারী ভাদুধন।
রাজকুমারী ভাদু আমার
দুখের মর্ম জানে না।
শুকাল দুধেরই গলা,
হায় মরি কাঁদে সনা।


ছবি - গুগল

                    "ভাদু উৎসবের" উৎপত্তি নিয়ে একটি কিংবদন্তির প্রচলন আছে, তা হল - পুরুলিয়া জেলার (মানভূম) অন্তর্গত কাশিপুরের মহারাজা শ্রী নীলমণি সিং দেও - এর একটি পরমাসুন্দরী কন্যা ছিলেন। তার নাম "ভদ্রেশ্বরী"। এই কন্যাটির অকাল - মৃত্যু হওয়ায় রাজা দারুন মানসিক আঘাত পান এবং কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে ভাদ্র মাসে ভাদু উৎসব সারা রাজ্যে প্রচলন করেন। কিন্তু বাস্তবে আদৌ এরূপ কোন ঘটনা ঘটেনি, এমনকি রাজা নীলমণি সিং দেও - এর ভদ্রেশ্বরী বলে কোন কন্যাই ছিল না। উপরে উল্লিখিত গানটিতে রাজকুমারী শব্দটি আসলে গৌরবার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও কাশীপুরের রাজবাড়িতে আজও ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

কাশীপুরের মাহারাজা
সে করে ভাদু পূজা
হাতেতে মা জিলপি খাজা
পায়েতে ফুল বাতাসা।

                    কেউ কেউ আবার ভাদু উৎসবকে "করম উৎসবের" হিন্দু সংস্করণ বলে অভিহিত করেন। ছোটনাগপুরের আদিবাসী এবং কুর্মী ক্ষত্রিয় সম্প্রদায় ভাদ্র মাসে এই উৎসব পালন করেন। একটি ঝুড়িতে পঞ্চশস্য আর বালি রেখে কিছু লৌকিক আচার এবং সংগীত সহযোগে এই উৎসব পালন করা হয়। এই গানগুলিকে "জাউয়া" গান বলা হয়। কিন্তু ভাদু ও জাউয়া গানের ভাবাগত কিছু মিল ছাড়া তেমন কোনো মিল এই উৎসবদুটির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তাই ভাদু উৎসবকে করম উৎসবের সংস্করণ বলাও ঠিক নয়।

ছবি - গুগল

                    আসলে ভাদু উৎসব হলো ফসল ফলানোর উৎসব। ফসলের সাথে এই উৎসবের যোগ অত্যন্ত নিবিড়। জৈষ্ঠ্যের শেষ থেকে পুরোদমে চাষ শুরু হয়, এক নাগাড়ে চলে শ্রাবণ পর্যন্ত। এই সময় পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েদেরও চাষের কাজে ঘাম ঝরাতে হয়, বিশ্রাম নেবার সময়টুকু পর্যন্ত পাওয়া যায়। অবশেষে ভাদ্র মাসে আসে বিশ্রামের সময়। মেয়েদের হাতে কোনো কাজই থাকে না এই সময়ে। পুরুষদেরও নিড়ানো এবং ক্ষেতের দিকে নজর রাখা ছাড়া তেমন কোন কাজ থাকে না। ভাদ্রের এই অবসরের পর জয়লাভের পালা, আনন্দের পালা, ফসল ফলিয়ে আনন্দ, আনন্দ সারা বছরের অভাবের পর কিছুটা সচ্ছলভাবে সংসার করার। সারাটা বছর এই কয়েকটা মাসের দিকেই তাকিয়ে থাকেন চাষীরা। গ্রামীণ সমাজজীবনের এই সমস্ত বিষয়, বিভিন্ন পৌরাণিক গাঁথা এবং গ্রামবাংলার আরোও ছোট খাটো বিভিন্ন বিষয়গুলিই ভাদু সংগীতে স্থান পায়। তাই ভাদু রাজকন্যা নন, ভাদু নন করমের হিন্দু সংস্করণ, ভাদু হল আনন্দের প্রতীক, ফসলের প্রতীক, ভাদু "ফসল ফলানোর উৎসব"।

আষাঢ় মাসে চাষ কৈরেছি
আনব ভাদু ভাদরে।
দামুদরে বান ডেকে্যছে
খেয়া লাউ নাই চলে।
হেই দামুদর পায়ে পড়ি
টুক্চা তুমি বান কমাও।
বছ্র পরে ভাদু আসবেক
লাউ বুকে ভাসতে দাও।


ছবি - গুগল

                    ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে সংক্রান্তি পর্য্যন্ত হলো ভাদু উৎসবের সময়। ভাদ্রের প্রথম দিনেই স্থানীয় মৃৎশিল্পী দ্বারা নির্মিত একটি ছোটো আকারের নারীমূর্তি নিয়ে আসা হয়। যদিও মূর্তি ছাড়াও ভাদু উৎসব হতে দেখা যায় কিছু কিছু জায়গায়। যাই হোক, এরপর একটি বিশেষ স্থানে মূর্তিটিকে উপবিষ্ট করে পাড়ার বা পরিবারের মহিলারা সমবেত হয়ে প্রাক সংক্রান্তি পর্য্যন্ত প্রতি রাত্রে গানের আসর বসান। গানগুলির কিছু পূর্বশ্রুত এবং কিছু নিজেদের রচনা থাকে। তবে সংক্রান্তির রাত্রিটি মূল উৎসবের রাত্রি, এই রাতটিকে ভাদু - জাগরন বলা হয়। এই রাতটি আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয়। এই দিনে একটি বা দুটি চৌকির উপর ফুলপাতা দিয়ে মেরাপ সাজিয়ে সেই মেরাপে ভাদুকে বসানো হয়। মেরাপ সাজানোর একটি প্রতিযোগিতাও দেখা যায়। সকাল থেকেই যেন একটা উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। ময়রার দোকানে মিঠাই তৈরি, ঘরে ঘরে চালের গুড়ি দিয়ে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যসামগ্রী তৈরির কাজ লেগেই থাকে। গৃহকর্ম সেরে পাড়ার মহিলারা ভাদুর জন্য প্রস্তুত মিষ্টান্ন ও ফলে পরিপূর্ণ থালা হাতে সমবেত হন একটি নির্দিষ্ট স্থানে এবং সংগীতে অংশগ্রহণ করেন। মাটির উপর সতরঞ্জি বিছিয়ে সকলে ভাদুকে আহ্বান করতে বসেন। ভাদু ঘরের মেয়ে, অত্যন্ত প্রিয়জন, অত্যন্ত গরবিনী। সে না থাকলে চারিদিকে নিরানন্দ, ঘরে শান্তি নেই। ভাদু এলেই তার সাথে আসবে আনন্দ, হাসি মুখ ফুটে উঠবে ঘরে ঘরে। সারারাত ধরে চলে উৎসব। মহিলারা পাড়ায় পাড়ায় ভাদু দেখতে বের হন। কখনো কখনো দর্শনার্থীদের সংগীতে যোগদান করার জন্য আহ্বানও করা হয় ঃ-

ভাদু বৈল্তে আলি তোরা
বৈস্ লো তোরা ছাঁচকলে।
পাৎনা ভৈরে মাড় রাখে্যছি
খা লো তোরা প্যাট ভৈরে্য।


ছবি - গুগল

দর্শনার্থীদের দল ভাদুর কোনো খুঁত পেলে সঙ্গে সঙ্গেই গান রচনা করেন ঃ-

এই ভাদুটি কে গৈড়েছে
নীলু ছুতার মিস্তিরি?
গড়নে গৈড়েছে ভালো
গলায় দেয় নাই চাপকলি।

ভাদুর এই নিন্দা মাথা হেঁট করে মেনে নেওয়া যায় না। তাই সঙ্গে সঙ্গে তার প্রত্তিতরও আসে ঃ-

তুদের ভাদু পৈরতে খুজে
নূতন ছকের কাল্লাফুল
হাতে নাই পুরাণ সিকি
এত কিসের সাধ ট তুর।

                    এমনিভাবে আনন্দ - উৎসব, বাদ - প্রতিবাদ, হাসি - তামাশার মধ্যেই রাত্রি প্রভাত হয়। মেয়েদের কন্ঠে কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে বিদায় সংগীত। জাগরণক্লান্ত দেহমনে নেমে আসে বিচ্ছেদ বেদনা ঃ-

ভাদু বিদায় দিতে,
প্রাণ আমাদের চাইছে না কোনো মতে।

তবু কিন্তু বিদায় দিতে হবে ঃ-

ওরে মাধুরী, শুধু শুধু বসলি কেন ভাবিতে
ভাদু যাবেন শ্বশুর বাড়ি - সাজাও গো কোনো মতে।
ভাদু বিদায় দিতে ...

প্রভাতে একটি পুরুষ বা মহিলার মাথায় ভাদুকে স্থাপন করে মেয়েরা দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে বিসর্জন দিয়ে আসেন নিকটস্থ জলাশয়ে বা নাদীতে।

ছবি - গুগল

তথ্যসূত্র ঃ- ভাদু ও টুসু (রামশঙ্কর চৌধুরী)

ভাদু গানের নমুনা ঃ- https://www.youtube.com/watch?v=MwLvSwW4PWI
                               https://www.youtube.com/watch?v=eEy3uN8l52g
                               https://www.youtube.com/watch?v=4pHD5rBXDE4


আরও পড়ুন, আরও জানুন ঃ-
বাউল - https://satyakikarmakar.blogspot.com/2018/12/blog-post.html
কবিগান - https://satyakikarmakar.blogspot.com/2018/12/blog-post_28.html


No comments:

Post a Comment

Babughat

M.A. 3rd Semester Examination 2018 in Journalism and Mass Communication JMC - 304CC - Part B Roll. No. - 92/JMC/171017 -:: এ...