Friday, December 28, 2018

"কবিগান"

-:: কবিগান ::-

বাংলা সাহিত্যে বা যেকোনো ভাষার সাহিত্যের ক্ষেত্রেই কবিতার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা আমরা সকলেই জানি। আর বাংলা সাহিত্যের সূচনাকালে সাহিত্য রচনার অন্যতম প্রধান মাধ্যমই তো ছিল পদ্য কবিতা। সেই শুরুর সময় থেকে বহু কবি এসেছেন এবং নিজেদের প্রতিভা ও ভাষার উপর দক্ষতার মধ্য দিয়ে লিখে গেছেন অজস্র কালজয়ী কবিতা, যেগুলি পড়ে আজও আমরা মোহিত হয়ে যায়। কিন্তু এই কবিতাগুলি যদি গান হয়ে ওঠে, তাহলে কেমন হয় বলুন তো? কি, রবীন্দ্র সংগীত? আরে না না, আর একটু চেষ্টা করে দেখুন। বাউল? না না বাউলের কথাও বলছি না। আচ্ছা দাঁড়ান আরেকটু ক্লু দিচ্ছি, ধরুন আপনি আপনার প্রতিবেশী ন্যাপলার সঙ্গে ঝগড়া করছেন, কিন্তু অন্য সবার মত না, আপনারা ঝগড়া করছেন কিছুটা ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে, সুর করে করে। নিন, এবার বলুন তো আমি কিসের কথা বলছি? কি, তাও বুঝলেন না, আরে "কবিগান"-এর কথা বলছি, কবিগানের। অবশ্য কবিগানের এখন যা অবস্থা তাতে আপনার এই বিষয়ে বেশি কিছু জানার কথাও নয়। আপনারা তো এখন অরিজিত সিং - শ্রেয়া ঘোষালের গান শোনাতেই ব্যস্ত। তবে যদি কবিগান সম্বন্ধে কিছু জানার ইচ্ছা থাকে, তবে সামান্য একটু সময় নষ্ট করে সম্পূর্ণ লেখাটা পড়তে পারেন।

ছবি - গুগল

                  "কবিগান" করেন মূলত বাংলার লোককবিরা। এটি বাংলা লোকসঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারাও বটে। এই ধারায় লোককাবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। সাধারনত দুটি দলের দ্বারা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই গান করা হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন "কবিয়াল" বা "সরকার"। তার সহকারি গায়কদের বলা হয় "দোহার"। এরা সাধারনত কবিয়ালের কথাগুলিরই পুনরাবৃত্তি করে থাকেন। "বন্দনা" বা "গুরুদেবের গীত"-এর মাধ্যমে শুরু হয় কবিগানের আসর। "বন্দনা" অংশটি সরস্বতী, গণেশ, জনতা ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এরপর রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান গাওয়া হয়, এই পর্যায়েটিকে কেউ কেউ "আগমনী"ও বলে থাকেন। এরপর চারটি বিষয়ভিত্তিক গান গাওয়া হয়,- "সখী সংবাদ", "বিরহ", "খেউড়" ও "লহর"। "সখি সংবাদে" রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের গান গাওয়া হয়। "বিরহ" পর্যায়ে মানবজীবন বা মানবদেহের বিচ্ছেদ সম্বন্ধীয় গান গাওয়া হয়। "খেউর" পর্যায় চলে দেবদেবী সম্বন্ধীয় গান নিয়ে। আর এরপরই শুরু হয় মূল প্রতিযোগিতার অংশ, যা "লহর" নামে পরিচিত তবে কেউ কেউ একে "কবির লড়াই"ও বলে থাকেন। এই অংশে একজন গীতিকার-সুরকার মুখে মুখে গান বেঁধে অপর গীতিকার-সুরকারকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমে সেই আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেন।

"জাতিস্মর" চলচ্চিত্র থেকে (ছবি - গুগল)

                  শতাব্দীর প্রথম ভাগে এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এই গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকাল নব্য কবিগান এবং পাঁচালী গান কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে বর্তমানে কলকাতায় কবিগানের কোনো আসর তো প্রায় হয়ই না, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও এর জনপ্রিয়তা বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে।
              অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে একাধিক সংখ্যক কবিয়াল  বা কবিওয়ালা জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই সময় কেবলমাত্র বীরভূম জেলাতেই শ তিনেক খ্যাতনামা কবিয়ালের বসবাস ছিল। যার মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবিয়াল ছিলেন "গোঁজলা গুই"। উনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার বিখ্যাত কবিয়ালরা ছিলেন,- "হারু ঠাকুর", "নিতাই বৈরাগী", "রাম বসু", "ভোলা ময়রা" ও "অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি"। এদের মধ্যে অ্যান্টনি ছিলেন জন্মসূত্রে পর্তুগিজ। তার জীবন অবলম্বনেে "অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি" ও "জাতিস্মর" নামের দুটি বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কবিয়ালদের মধ্যে ভোলা ময়রার জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক। তার গান শুনে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতেন। তার জীবন অবলম্বনেও "ভোলা ময়রা" নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এরা ছাড়াও বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের কবিয়ালদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন,- "বলহরি দে", "শম্ভুনাথ মন্ডল", "তারকচন্দ্র সরকার", "রমেশচন্দ্র শীল", "রাজেন্দ্রনাথ সরকার" প্রমূখ। চারণকবি "মুকুন্দ দাস" প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন কবিয়াল "বালিকা বধূ" চলচ্চিত্রে তার চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় কবিয়াল হলেন "অসীম সরকার"।

"অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি" চলচ্চিত্র থেকে (ছবি - গুগল)

                  কবিওয়ালগণ মুখে মুখে কবিতা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু কখনোই সেগুলো লিখে রাখেননি তাছাড়াও তাদের সমর্থক কিংবা পৃষ্ঠপোষকগণও কখনো গানগুলি সংগ্রহ করার কথা ভাবেনি। তবে ১৮৫৪ সালে সর্বপ্রথম কবি ঈশ্বর গুপ্ত কবিগান সংগ্রহ করা আরম্ভ করেন। এগুলো পরবর্তীতে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করতেও শুরু করেন যা কবিগানের বৃষ্টিতে কিছুটা হলেও সহায়তা করেছিল।
                 তো এই হল কবিগানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। যদি সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ে থাকেন তবে আশা করছি কিছুটা হলেও কবিগান কি তা জানতে পেরেছেন বা বুঝতে পেরেছেন। তবে যদি এই লেখাটি পড়ে কবিগানের উপর কিছু আগ্রহ জন্মায় বা আরোও জানতে ইচ্ছা করে তবে আগে যে চলচ্চিত্রগুলির কথা উল্লেখ করেছি সেগুলো সময় করে দেখে নিতে পারেন, আর গ্রামবাংলায় এখনো যে কিছু কিছু কবিগানের আসর বসে সেখানে গিয়ে বিনামূল্যে গান শুনে আসতে পারেন। আর হ্যাঁ, ভালো লাগলে কবিগানের অস্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা রক্ষার স্বার্থে এই গানের বিষয়ে অন্যকে জানাতে এবং তাদের আগ্রহী করে তুলতে ভুলবেন না যেন।

তথ্যসূত্র ঃ- উইকিপিডিয়া।

কবিগানের নমুনা ঃ- https://www.youtube.com/watch?v=rfkrM7hFRlA
                              https://www.youtube.com/watch?v=KON8T9RHgnk
                              https://www.youtube.com/watch?v=ftcNKOiLvN4


আরও পড়ুন, আরও জানুন ঃ-
বাউল - https://satyakikarmakar.blogspot.com/2018/12/blog-post.html
ভাদু - https://satyakikarmakar.blogspot.com/2019/01/blog-post.html


Tuesday, December 11, 2018

"বাউল"

-:: বাউল ::-

"মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে"

মনের মানুষের সাথে মিলন হোক বা না হোক, কথাটা শুনে যে শব্দটি প্রথম আমাদের তথা আপামর বাঙালির মাথায় আসে তা হল 'বাউল' বা 'বাউল গান'। বাংলা লোকগানের সবচেয়ে জনপ্রীয় ধারা, যে ধারা আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত তার নিজগুনে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে মানবজাতির ঐতিহ্যের স্মারক রুপে সংরক্ষনের সিদ্ধান্তও নিয়েছে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-পাবনা-যশোর-ফরিদপুর থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-নদীয়া-বর্ধমান-বোলপুর-জয়দেবকেন্দুলি পরযন্ত্য বিস্তৃতি লাভ করেছে বাউল গান।

ছবি - গুগল

              প্রধানত বাউল একটি বিশেষ 'লোকাচার', যদিও কারো কারো মতে 'ধর্মমত'ও বটে। এই মতের সৃষ্টি বাংলার মাটিতেই। অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন এর উৎপত্তি সম্বন্ধে বলেছেন - "ভারত-বাংলা উপমহাদেশের একটা বিশিষ্ট ও প্রাচীন মরমিয়া সাধনা বৈদিক যুগ থেকে প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধধর্মে এই মরমিয়া সাধনা একটা নতুন রুপ নেয়। এই ধারার মাহাযান শাখা বাংলাদেশে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে এবং তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় ব্রজযোগীনির পাহাড়পুর ও ময়নামতির বিহারে। তন্ত্র সাধনপদ্ধতি তথা শিল্প পদ্ধতির মধ্যেও এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই তন্ত্রবাদেই লোকায়ত দর্শনের জন্ম। বাউল দর্শন এই লোকায়ত দর্শনের অংশবিশেষ"।


ছবি - গুগল

                কেউ বলেন বাউল শব্দটি বায়ু শব্দের সাথে যুক্ত এবং এই বায়ু শব্দের অর্থে যোগশাস্ত্রের স্নায়বিক শক্তির সঞ্চার বোঝায়। যে সম্প্রদায় দেহের স্নায়বিক শক্তির সঞ্চার সাধন করবার সাধনা করেন, তারাই বাউল। আবার কারোর মতে, বায়ু মানে শ্বাসপ্রশ্বাস এবং  শ্বাসপ্রশ্বাস-এর অর্থ জীবনধারণ এবং তাহা সংরোধ করে দীর্ঘ জীবনলাভ করবার সাধনা করেন যারা, তারা বাউল। তবে দেহতত্ত্বের সাধনা দ্বারা পরমাত্মার সন্ধান করাই বাউলদের মূল মন্ত্র। তারা মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি প্রভৃতি প্রতিকের ভাষায় পরমাত্মাকে আভিহিত করে। তিনি মানবদেহে বাস করেন। পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলন সাধন তাদের দেহ সাধনার মূল লক্ষ্য। আধ্যাত্মপ্রেম তথা ভক্তি দ্বারা এ মিলন সাধন সম্ভব। লালনের ভাষায় - "আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা"।

                বাউল গান ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে এই গানের অন্যতম প্রধান স্রষ্টা লালন শাহ্‌ - এর মধ্য দিয়ে। তার জন্মস্থান কষ্টিয়ার ভাড়রা গ্রামলালন অনেক শিষ্য - প্রশিষ্য গ্রহণ করে বাউল সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেন। তিনি বাউল গান রচনা করে নিজে গাইতেন, তার শিষ্যরাও গাইত। পরবর্তীকালে শিষ্য - প্রশিষ্যদের কাছ থেকে লালনের গান সাংগ্রহ করা হয়েছে। দুদ্দু শাহ্‌, পাঞ্জু শাহ্‌, পাগলা কানাই প্রমূখ তার উল্লেখযোগ্য শিষ্য ছিলেন। তারাও লালনকে অনুসরণ করে বহু বাউল গান রচনা করেছেন। লালনের গানের সাংখ্যা আনুমানিক দুই থেকে আড়াই হাজার। লালন মানবদেহ ও মানবজীবনকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন -

"শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই
দেব - দেবতাগণ করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে"


লালন শাহ্‌ (ছবি - গুগল)

তিনি জাতিভেদেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন -
"জাত গেল জাত গেল চলে
একি আজব কারখানা"

তিনি বলেছেন - "জাত হাতে পেলে পুরাতাম আগুন দিয়ে"। রবীন্দ্রনাথ বাউলদের জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদমুক্ত জীবনবোধ ও ধর্ম্যাদর্শের প্রশংসা করে একে মানবধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের বহু গান সংগ্রহ করে প্রকাশও করেছিলেন। এমনকি তার নিজের লেখা অনেক গানেও বাউল গানের প্রভাব সুস্পষ্টরূপে লক্ষ্য করা যায়।

                বাউল গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র একতারা। কোনো কোনো বাউল কোমরে বাঁয়া বাঁধে। ডান হাতে একতারা এবং বাম হাতে বাঁয়া বাজিয়ে বাউলরা একা অথবা দলবদ্ধভাবে গান - নাচ করে। এছাড়া বাউল গানের উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র হল - খমক, দোতারা, খোল, ডুগী প্রভৃতি।


ছবি - গুগল

                লালন ছারাও আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য বাউল কবি হলেন - জগম্মোহন গোঁসাই, সিরাজ সাঁই, হাসন রাজা, দ্বিজদাস, মুকুন্দ দাস, শাহ্‌ আব্দুল করিম, কবি জয়দেব, ভবা পাগলা, জালাল খাঁ, রশিদ উদ্দিন, হরিচরণ আচার্য, পূর্ণদাস বাউল প্রমূখ।

তথ্যসূত্র ঃ- উইকিপিডিয়া

                বাউল গানের কয়েকটি নমুনা ঃ- https://www.youtube.com/watch?v=_tEV7aph-mU
                                                               https://www.youtube.com/watch?v=4ZX4IwwVTLw
                                                               https://www.youtube.com/watch?v=RGy4MhpMPKE
                                                               https://www.youtube.com/watch?v=FBpFTy4BO_Q
                                                               https://www.youtube.com/watch?v=UOSm81--rLc
                                                              
                                                               
আরও পড়ুন, আরও জানুন ঃ-

কবিগান - https://satyakikarmakar.blogspot.com/2018/12/blog-post_28.html
ভাদু - https://satyakikarmakar.blogspot.com/2019/01/blog-post.html


Babughat

M.A. 3rd Semester Examination 2018 in Journalism and Mass Communication JMC - 304CC - Part B Roll. No. - 92/JMC/171017 -:: এ...